কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলার বিচার শুরুর প্রথম দিনে সাক্ষ্য গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্য গ্রহণ।
সোমবার (২৩ আগস্ট) সকালে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈলের আদালতে মামলার বাদী সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌসের সাক্ষ্যদানের মধ্য দিয়ে বিচারকাজ শুরু হয়। এ সময় মামলার ১২ আসামির আইনজীবীরা আদালতে বাদীকে জেরা করেন। বাকি তিন আসামির আইনজীবীর জেরা দ্বিতীয় দিনের সাক্ষ্যগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে সকাল পৌনে ১০টায় মামলার ১৫ জন আসামিকে একটি প্রিজন ভ্যানে করে কক্সবাজার জেলা কারাগার থেকে কড়া পুলিশ পাহারায় আদালতে আনা হয়।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ফরিদুল আলম জানান, প্রথম দিনে আদালতে ৩ জন সাক্ষী উপস্থিত ছিলেন। তবে সাক্ষ্য নেওয়া সম্ভব হয়েছে একমাত্র বাদির। এ সময় ওসি প্রদীপ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত ও এএসআই লিটন মিয়ার আইনজীবী ছাড়া অন্য ১২ আসামির আইনজীবীরা সাক্ষীকে জেরা করেন। পরে বিচারক বাকি ৩ আসামির আইনজীবীদের জেরা মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে আদেশ দিয়ে আদালতের কার্যক্রম মুলতবি ঘোষণা করেন।
ফরিদুল আলম আরও জানান, কাল সোয়া ১০টায় মামলার বাদী সাক্ষ্য প্রদানের জন্য আদালতের এজলাসে হাজির হলে আসামিদের আইনজীবীরা নানা আপত্তি তুলে ধরেন। পরে বিচারক আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনার পর সোয়া ১১টায় বাদীর সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন। দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত সাক্ষ্য গ্রহণ চলে। এরপর ১২ জন আসামির আইনজীবীরা একের পর এক সাক্ষীকে জেরা শুরু করেন। একপর্যায়ে বিকেল ৩টায় বিচারক আদালতের কার্যক্রম এক ঘণ্টার জন্য বিরতি ঘোষণা করেন। বিকেল ৪টায় আবার বিচারকাজ শুরু হয়। তা শেষ হয় বিকাল ৫টায়।
আদালত থেকে বেরিয়ে মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বলেন, “সিনহা হত্যা ঘটনার পর প্রত্যক্ষদর্শীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে মামলার এজাহারে যে বর্ণনা দিয়েছিলাম মূলত তা-ই আদালতের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। এখন তারই ভিত্তিতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাকে জেরা করছেন।”
“এছাড়া মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে সিনহা হত্যার ঘটনাটি পরিকল্পিত বলে তুলে ধরা হয়েছে; তাও আদালতের কাছে উপস্থাপন করে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি করেছি”, বলেন মামলার বাদী।
শারমিন আরও বলেন, “আমার সাক্ষীর ওপর এখনো ৩ জন আসামির আইনজীবীর জেরা অসম্পন্ন রয়েছে। মঙ্গলবার (২৪ আগস্ট) তা অনুষ্ঠিত হবে। আশা করছি আদালতের কাছে আমরা ন্যায়বিচার পাব।”
বাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, “সাক্ষ্যদানের শুরু থেকেই আসামিদের আইনজীবীরা বিচারকাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য নানা চেষ্টা চালায়। তারা আদালতের কাছে ১১টি আপত্তিপত্র জমা দিলেও সাক্ষ্যদান সুষ্ঠুভাবে শুরু হয়েছে।”
আইনের ব্যাখা দিয়ে আসামি ওসি প্রদীপ ও এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতের আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বলেন, “মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর আগে আসামিদের অভিযোগ গঠন এবং অভিযোগ গঠনের আদেশ সম্পর্কে জানতে হবে। এতে তাদের (আসামিদের) বিরুদ্ধে কী ধরনের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু আসামিরা এখনো তা অবগত নয়। গত ২৭ জুন অভিযোগ গঠন করে আদেশের পর সেগুলোর নথি পেতে আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেগুলো (নথি) পাইনি।”
আসামিপক্ষের এ আইনজীবী বলেন, “অভিযোগ গঠনের নথি আবেদনের পরও না পাওয়ার বিষয়টি আদালতের কাছে তুলে ধরে পিটিশন দায়ের করি। আদালত বিষয়টি আমলে নিয়েছেন আদালত।”
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি ফরিদুল আলম বলেন, “করোনার কারণে মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছিল। এখন সাক্ষ্য যখন শুরু হয়েছে তা আর দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সুযোগ নেই। এ নিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে মামলার চুড়ান্ত বিচারকাজ সম্পন্ন করতে পারব আশা করছি।”
আদালত সূত্র জানায়, গত ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য থাকলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে পিছিয়ে যায়। পরে ১৬ আগস্ট আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে ২৩, ২৪ ও ২৫ আগস্ট সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দেন। সিনহা হত্যা বিচারকার্য শুরুর প্রথম দিনে সাক্ষ্যদানের জন্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন মামলার বাদী ও সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস, ঘটনার সময় সঙ্গে থাকা সিনহার সঙ্গী শহিদুল ইসলাম সিফাত ও টেকনাফের মিনাবাজার এলাকার মোহাম্মদ আলী।
গত বছর ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। এ ঘটনায় সেই সময় সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদি হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় লিয়াকত আলীকে। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেন।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় একটি এবং রামু থানায় আরেকটি মামলা করে। সিনহা নিহতের ৬ দিন পর সাবেক পরির্দশক লিয়াকত আলী ও সাবেক ওসি প্রদীপসহ সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার অভিযোগে টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টে ঘটনার সময় দায়িত্ব পালনকারি আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। এক পর্যায়ে পলাতক থাকা অবস্থায় টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
সর্বশেষ গত ২৪ জুন মামলার একমাত্র পলাতক থাকা আসামি টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করে। সাবেক এএসআই সাগর দেব ছাড়া র্যাব ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চালায়। এদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
তদন্ত শেষে গত বছর ১৩ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৎকালীন র্যাব-১৫ দায়িত্বরত সহকারী পুলিশ সুপার মো. খাইরুল ইসলাম ১৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
মামলার আসামিরা হলেন বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল-মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এপিবিএনের তিন সদস্য এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব, মো. আব্দুল্লাহ, পুলিশের মামলার তিন সাক্ষী নুরুল আমিন, নেজাম উদ্দিন, মো. আয়াজ, টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাবেক এএসআই সাগর দেব।